১.৪ খাদ্য সংরক্ষণ

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বিজ্ঞান - উন্নততর জীবনধারা | NCTB BOOK

প্রাকৃতিক কারণে সব ধরনের খাদ্য সময়ের সাথে নষ্ট বা খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। খাদ্য নষ্ট হওয়ার কারণগুলো হচ্ছে: জীবাণু ও ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হওয়া এবং পরিবেশের কারণে সেগুলোর দ্রুত বৃদ্ধি, খাদ্যের মধ্যে উৎসেচকের বৃদ্ধি, পরিবেশে আর্দ্রতা, তাপে অম্লের পরিমাণ বৃদ্ধি। এই কারণগুলো এককভাবে খাদ্যকে নষ্ট করে না। কয়েকটি কারণ একত্রে সংগঠিত হয়ে খাদ্য নষ্ট করে। যেমন, পরিবেশে আর্দ্রতা বৃদ্ধি পেলে জীবাণুর বৃদ্ধি ঘটে এবং খাবারকে নষ্ট করে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে খাদ্যবস্তুর উৎসেচকের পরিমাণের বৃদ্ধি ঘটে খাদ্যকে নষ্ট করে দেয়।

জীবাণু বা ব্যাকটেরিয়া খাদ্য নষ্ট করে সেখানে এক ধরনের বিষাক্ত উপাদান তৈরি করে। এই বিষাক্ত উপাদানগুলোকে টক্সিন বলে। এই টক্সিনগুলো নানা ধরনের হয় এবং কোনো কোনো টক্সিনে আক্রান্ত হওয়াকে আমরা ফুড পয়জনিং বলে থাকি। টক্সিন স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে।

ইস্টজাতীয় ছত্রাক ফলের রস, টমেটোর সস, জেলি, মিষ্টি আচার, শরবত ইত্যাদি খাবার দ্রুত নষ্ট করে ফেলে। এতে খাবারে টক গন্ধ হয় এবং ঘোলাটে হয়ে যায়। যদি পাউরুটি কয়েক দিন খোলা স্থানে রাখা যায়, তাহলে দেখা যায় এর ওপর ধূসর বর্ণের আবরণ তৈরি হয়েছে। এটি মোলড জাতীয় ছত্রাক (যেমন: মিউকর, এসপারজিলাস) দ্বারা আক্রান্ত হয়ে নষ্ট হয়ে যায়। কমলালেবু, টমেটো, পনির, আচার প্রভৃতি টকজাতীয় খাবার এগুলোর দ্বারা সহজে নষ্ট হয়।

খাদ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে আমরা এক ঋতুর ফল, শস্য, সবজি, মাছ এবং অন্যান্য খাদ্য অন্য ঋতুতেও পেতে পারি। বছরের কোনো একটি সময়ে ও স্থানে কোনো ফসলের উৎপাদন বেশি হলে তা সংরক্ষণের মাধ্যমে অন্য সময়ে ব্যবহার, বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তর বা রপ্তানি করতে পারি। কাজেই খাদ্যের গুণগত মান ঠিক রেখে বিভিন্ন প্রকার খাদ্য বিভিন্ন উপায়ে আমরা সংরক্ষণ করে আমরা আমাদের খাদ্যঘাটতি মেটাতে পারি।

১.৪.১ খাদ্য সংরক্ষণের বিভিন্ন পদ্ধতি

খাদ্য নষ্ট হয় জীবাণু বৃদ্ধি ও জীবাণু দ্বারা নিঃসৃত উৎসেচকের ক্রিয়ার কারণে। পানি ও উষ্ণতা জীবাণু বৃদ্ধি ও উৎসেচকের ক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্য খুবই উপযোগী অবস্থা। ফলে এ অবস্থা খাদ্যকে দ্রুত পচনে প্রভাবিত করে। পচনের সাহায্যকারী এসব বিষয়কে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে খাদ্য বহুদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা সম্ভব।

বিশেষ কিছু ব্যবস্থা অবলম্বন করে বাণিজ্যিকভাবে খাদ্য সংরক্ষণ ও বাজারজাত করা হয়। আমাদের বাসায় সাধারণ সংরক্ষক দ্রব্যের ও যন্ত্রপাতির ব্যবহারে খাদ্য সংরক্ষণ করা হয়। এরকম কয়েকটি পদ্ধতির নাম এখানে উল্লেখ করা হলো:

১. শুষ্ককরণ: খাদ্যবস্তুকে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা একটি প্রাচীন পদ্ধতি। শুষ্ককরণ পদ্ধতিতে খাদ্যবস্তু থেকে পানি শুকিয়ে ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া জন্ম এবং এনজাইম ক্রিয়াকে প্রতিহত করা যায়। খাদ্যকে অনেক দিন পর্যন্ত এভাবে সংরক্ষণ করা যায়।

২. রেফ্রিজারেশন: রেফ্রিজারেশন পদ্ধতিতে কাঁচা শাক-সবজি, ফল, রান্না করা খাদ্য, মিষ্টিজাতীয় খাবার কিছুদিন পর্যন্ত রাখা যায়। এ পদ্ধতিতে জীবাণুর বংশবৃদ্ধি ও এনজাইমের ক্রিয়া, কোনোটাই দীর্ঘদিনের জন্য প্রতিরোধ করা যায় না।

৩. ফ্রিজিং: ফ্রিজিং পদ্ধতিতে খাদ্যকে ও খাদ্যদ্রব্যকে ০° ফারেনহাইট অথবা তার নিচের তাপমাত্রায় রাখা হয়। এ পদ্ধতিতে খাদ্যদ্রব্য দীর্ঘদিন ভালো থাকে। ফ্রিজিং পদ্ধতিতে শুধু টাটকা শাক-সবজি, ফল, ফলের রস, মাছ, মাংস সংরক্ষণ করা হয় না, এ পদ্ধতিতে প্রস্তুতকৃত খাবার, আইসক্রিম এবং বিভিন্ন রকমের তৈরি খাবারও সংরক্ষণ করা যায়।

৪. সংরক্ষক দ্রব্য: রাসায়নিক পদার্থের দ্বারা খাদ্যের পচন রোধ করা যায়। এগুলোকে সংরক্ষক (Preservative) বলে। খাদ্যকে পচন থেকে রক্ষা করা এবং খাদ্যে যেন ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে না পারে সেজন্য রাসায়নিক সংরক্ষক ব্যবহার করা হয়। এগুলোর কোনো পুষ্টিগুণ নেই। সঠিক পরিমাণের মাত্রা জেনে খাদ্যে সংরক্ষক প্রয়োগ করা উচিত। রাসায়নিক সংরক্ষক পদার্থগুলো বিভিন্ন ধরনের এবং ব্যবহারও বিভিন্ন রকম। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য রাসায়নিক সংরক্ষকের নাম নিচে উল্লেখ করা হলো: এগুলোর সঠিক পরিমাণের মাত্রা জেনে সংরক্ষণ খাদ্যে প্রয়োগ করা উচিত। রাসায়নিক সংরক্ষক পদার্থগুলো বিভিন্ন ধরনের এবং ব্যবহারও বিভিন্ন রকম ।

(ক) ভিনেগার আমাদের অতিপরিচিত। আচার, চাটনি, সস প্রভৃতিতে ভিনেগার ব্যবহার করে জীবাণুর বৃদ্ধি রোধ করা হয়। এসেটিক এসিডের ৫% দ্রবণকে ভিনেগার বলে।

(খ) সালফেটের লবণ যেমন Sodium bisulphite অথবা Potassium meta bisulphite ব্যবহার করে ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য অণুজীবের বৃদ্ধি প্রতিরোধ করা যায়।

(গ) Sodium benzoate, এটি Benzoic Acid এর লবণ। এটি বিশেষ করে ছত্রাক ইস্ট এর বৃদ্ধিকে প্রতিহত করে। ফলের রস, ফলের শাঁস ইত্যাদি সংরক্ষণের জন্য Sodium benzoate খুব উপযোগী।

উপরে উল্লিখিত রাসায়নিক সংরক্ষকগুলো ছাড়া Propionic Acid – এর লবণ এবং Sorbic Acid— এর লবণ Sorbates ব্যবহার করে দই, মিষ্টি, পনির, মাখন ও বেকারি সামগ্রী সংরক্ষণ করা হয়।

উপরে উল্লিখিত রাসায়নিক সংরক্ষকগুলো ভিন্ন ভিন্ন ধরনের খাদ্য সংরক্ষণের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণে ব্যবহার করতে হয়। এই রাসায়নিক পদার্থগুলোকে নির্দিষ্ট পরিমাণে ব্যবহার না করে যদি যথেচ্ছ ব্যবহার করা হয়, তাহলে সেগুলো মানবদেহে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।


৫. চিনি বা লবণের দ্রবণে সংরক্ষণ: চিনি ও লবণের দ্রবণ খাদ্যসংরক্ষক হিসেবে বহুবছর পূর্ব থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। লবণের দ্রবণকে ব্রাইন বলে। চিনি ও লবণের ঘন দ্রবণ বহি-অভিস্রবণের দ্বারা অণুজীবগুলোকে ধ্বংস করে খাদ্যকে পচন থেকে রক্ষা করে।চিনি প্রয়োগ করে ফলের জ্যাম, জেলি ও মারমালেড তৈরি হয়। পেয়ারা, আপেল, আনারসজাতীয় ফলকে কেটে পরিষ্কার করে চিনির ঘণ দ্রবণে রেখে বায়ু নিরোধী করে দীর্ঘদিন রাখা যায়। সংরক্ষিত খাদ্য ব্যবহারের আগে যদি খাদ্যের রঙের পরিবর্তন ঘটে অথবা খাদ্য ফুলে উঠে, খাদ্যের উপর সাদা অথবা কালো আন্তরণ সৃষ্টি হয় এবং খাদ্যের ওপরটা পিচ্ছিল হয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে খাদ্যে পচনক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এ ধরনের খাদ্য গ্রহণ করা যাবে না, কারণ তাহলে ফুড পয়জনিং হতে পারে।


১.৪.২ খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণে রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার ও এর শারীরিক প্রতিক্রিয়া

বর্তমানে দুধ, ফল, মাছ এমনকি মাংসকে পচন থেকে রক্ষা করার জন্য যথেচ্ছ ফরমালিন নামক বিষাক্ত একটি রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে। খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণের জন্য এর ব্যবহার নিষিদ্ধ। কিন্তু আমাদের দেশে কিছু অসাধু ও বিবেকবর্জিত ব্যবসায়ী তারপরও ফরমালিনকে খাদ্য সংরক্ষণে ব্যবহার করছে। এর দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারে বদহজম, পাতলা পায়খানা, পেটের নানা পীড়া, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, লিভার ও কিডনি নষ্ট হওয়াসহ ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধি হতে পারে। ফরমালিন দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারে মেয়েদের গর্ভজাত সন্তান বিকলাঙ্গ পর্যন্ত হতে পারে।বিভিন্ন ফল যেমন: আম, টমেটো, কলা ও পেঁপে যেন দ্রুত পাকে, তার জন্য Ripen এবং Ethylene নামক রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলো ফল পাকানোর জন্য ব্যবহার করলে সে ফলকে ৭-৮ দিন পর বাজারজাত করা উচিত। কিন্তু তা না করে অনেক সময় ২-৩ দিনের মধ্যে বাজারজাত করা হয়। এতে রাসায়নিক পদার্থগুলোর কার্যকারিতা থেকে যায় এবং এ ধরনের ফল খাওয়ার ফলে মানবশরীরে জটিল রোগ সৃষ্টি হতে পারে।
ফল পাকানোর জন্য ক্যালসিয়াম কার্বাইড নামক এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থকে ব্যবহার করা হয়। এটি এমন ধরনের যৌগ, যা বাতাসের বা জলীয় বাষ্পের সংস্পর্শে এসেই উৎপন্ন করে অ্যাসিটিলিন গ্যাস, যা পরবর্তীকালে অ্যাসিটিলিন ইথানল নামক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থে রূপান্তরিত হয়। এটি স্বাস্থ্যের ভয়নক ক্ষতি করে। আম যেন দ্রুত না পাকে এবং গাছে দীর্ঘদিন থাকে, সে জন্য আমাদের দেশে কিছু আম ব্যবসায়ী কালটার (Culter) নামের হরমোন জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ গাছে স্প্রে করে। এতে ফল দ্রুত পরিপক্ব হয় এবং না পেকে দীর্ঘদিন গাছে থাকে। এটিও স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়।

এসব বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার প্রতিরোধ করার জন্য ভোক্কা অধিকার রক্ষায় ভোরা আইন আরও কঠিনভাবে প্রয়োগ করার জন্য ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার করে সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এ ধরনের ফল না কেনার জন্য জনগণকে সচেতন হতে হবে। যারা এ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগ করে খাদ্য সংরক্ষণ করে এবং ফল পাকায়, তাদের বিরুদ্ধে কঠিন শান্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। এ ব্যাপারে ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং জনগণের সচেতনতা সবচেয়ে বেশি কার্যকর প্রভাব ফেলতে পারে।

 

 

Content updated By
Promotion